Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

করোনা তৃণমূলের চিকিৎসায় বাধা হতে পারেনি

মাহমুদুল হাসান

সেপ্টেম্বর ৯, ২০২০, ০৭:০৪ পিএম


করোনা তৃণমূলের চিকিৎসায় বাধা হতে পারেনি

দেশজুড়ে প্রায় চৌদ্দ হাজার ছুঁইছুঁই কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে সরকার তিনজনকর্মী নিয়োগ করেছেন। যারা নিজের গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।

এসব কেন্দ্রে বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা মেলে। ‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ স্লোগানে প্রথমে শুরু হলেও ২০১৭ সালের শুরু থেকে ‘কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার’-এর আওতায় এসব ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে। প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার ফসল এই প্রকল্প। কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে যোগ্য নেতৃত্ব।

ফলে নয়া ভাইরাস সংক্রমণেও বন্ধ হয়নি কার্যক্রম। ইতোমধ্যে একশ কোটিরও বেশিবার মানুষ এখান থেকে সেবা নিয়েছে। করোনাকালে নমুনা সংগ্রহের জন্য সারা দেশের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে।

গত মে মাসে আঘাতহানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে চিকিৎসা দিতেও এগিয়ে এসেছে কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) কর্মীরা। আগামীতে এই কেন্দ্র থেকে ডায়াবেটিসের মতো জটিল অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা প্রদানের চিন্তাভাবনা চলছে।

সিবিএইচসি সূত্রে জানা গেছে, এখাতের সাফল্যের পেছনে রয়েছে দক্ষ নেতৃত্বের কারিশমা। শীর্ষপদ থেকে তৃণমূল সর্বত্র চৌকস নেতৃত্ব ও কর্মঠ কর্মীবাহিনীর কারণে সিবিএইচসির সাফল্য এখন চারদিকে। বাড়ির পাশে এই সেবা পেয়ে দেশের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ খুশি। এসব অযুত সম্ভাবনার পেছনে রয়েছে কর্মীদের পরিশ্রম।

সিবিএইচসি কর্মীরা লাইন ডাইরেক্টরের প্রশংসায় মাতোয়ারা। করোনা সংক্রমণে শুরুতে লাইন ডাইরেক্টও ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশী সারা দেশের কর্মীদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে করোনার উপসর্গ আছে এমন রোগীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহের উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন।

এছাড়া ডিজিটাল স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে সম্ভাব্য রোগী চিহ্নিতকরণ এবং ডাটা সংগ্রহের মাধ্যমেও সিএইচসিপিরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি দেশে আঘাতহানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায়ও তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকের জনবলকে কাজে লাগান।

বিভিন্ন জেলার একাধিক সিবিএইচসিকর্মী বলেন, করোনাকালে স্যারের (ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশী) দক্ষ নেতৃত্বে আমরা প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজের সাহস পেয়েছি। কাজ করেছি। তার মতো দক্ষ লোকের নির্দেশনায় কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ারের কাজ আরও এগিয়ে যাবে।

সিবিএইচপি সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ থেকে এ (২০২০) পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতার ভিজিট সংখ্যা ১০০ কোটির বেশি। এর মাঝে দুই কোটি ৩২ লাখের বেশি জরুরি ও জটিল রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।

ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যা ৮৫ হাজারের বেশি। গর্ভবতী মায়ের প্রসব পূর্ববর্তী সেবা (এএনসি) ৮২ লাখ ২০ হাজার ৯৭০টি, প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি) ২৪ লাখ ১১ হাজার ৫৩৬টি। এই বিপুল সেবা গ্রামের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে পেয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ক্লিনিকগুলোতে ১৩ হাজার ৮৫০ জন সিএইচসিপি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর মাঝে ৫৪ শতাংশই নারী।

এছাড়া এক হাজার ৯৩৫ জন নারী সিএইচসিপি সিএসবিএ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। চার হাজার ক্লিনিকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু আছে। বছরে এসব ক্লিনিকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি ওষুধ সরবরাহ করে সরকার।

সূত্র জানায়, বেশির ভাগ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থানীয় কোনো ব্যক্তির জমিতে গড়ে উঠেছে। এর পরিচালনায় স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন। সরকারি বেতনভুক্ত যে তিনজন এখানে সেবা বা স্বাস্থ্য পরামর্শ দেন, তাদের অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট এলাকার।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জরিপে দেখা যায়, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে ওষুধ ও পরামর্শ পেয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। আর এই সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছে জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)।

কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. সহদেব চন্দ্র রাজবংশী বলেন, বিনামূল্যে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা বা ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া গ্রামের মানুষের জন্য কম পাওয়া নয়।

এলাকার মানুষদের নিয়ে গঠিত কমিটিই চালায় কমিউনিটি ক্লিনিক। এটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো কাজ। ভবিষ্যতে এসব ক্লিনিকে ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হবে।

তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে কমিউনিটি ক্লিনিককর্মীরা সেবা দিয়ে থাকেন। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায়ও সাহসিকতার সঙ্গে কর্মীরা প্রতিদিনই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।

করোনা আমাদের কর্মীদের সাহসিকতা ও আন্তরিকতার কাছে পরাজিত হয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদের কাজে বাধা হতে পারেনি।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতিতে প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্বোধন করেন। দেখতে দেখতে ২১ বছরে পা রাখা এ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।

মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ কতটা কাজে লেগেছে, তার চিত্র উঠে এসেছিল ‘কমিউনিটি ক্লিনিক : হেলথ রেভুল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে।

২০১৩ সালে সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা ওই প্রতিবেদনে তৃণমূলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির চিত্র তুলে ধরা হয়।

জানা যায়, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমাআটায় অনুষ্ঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’— এই বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়। এরপর থেকে অনেক দেশ কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার নানা উদ্যোগ নেয়া শুরু করে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়। প্রতি ছয় হাজার গ্রামীণ মানুষের জন্য একটি করে মোট ১৩ হাজার ৫০০ ক্লিনিক তৈরির পরিকল্পনা ছিলো।

১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং আট হাজার ক্লিনিক চালু হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে শত শত ক্লিনিক।

এরপর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-০৮) কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কীভাবে চালু করা যায়- সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। তবে পুরোপুরি ক্লিনিকগুলো চালু হয় ২০০৯ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ নামের প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় আগের ক্লিনিকগুলো মেরামত, নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ ও ওষুধ সরবরাহ করার মাধ্যমে তা চালু করা হয়।

আমারসংবাদ/এসটিএম