Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪,

রায় ঘোষণার আগেই মিন্নিকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

বরগুনা প্রতিনিধি

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০, ১১:১৮ এএম


রায় ঘোষণার আগেই মিন্নিকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস

বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের রায় বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর)। তার আগেই মিন্নিকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হলো গণমাধ্যমে। জানা গেলো, রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ডের পুরো ছক আঁকেন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে তারই স্কুলজীবনের বন্ধু সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ও তার সঙ্গীরা। আলোচিত এই মামলার রায় কাল ঘোষণা করা হবে।

রিফাত হত্যাকাণ্ডের আলোচিত এই মামলাটির তদন্ত করেন বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির। আজ থেকে প্রায় দুই মাস আগে তিনি তদন্ত শেষে বরগুনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে মিন্নিকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর এ সব তথ্য বেরিয়ে আসে।

সেই তদন্তে উঠে আসে, মিন্নির দ্বিতীয় স্বামী রিফাত শরীফ। তাকে হত্যার পরিকল্পনায় মিন্নিকে সহযোগিতা করেন প্রথম স্বামী নয়ন বন্ড। কেন, কীভাবে, কারা রিফাত শরীফকে হত্যা করেছে- তা স্পষ্ট উঠে এসেছে মামলার তদন্তে।

মামলার ২৪ আসামির মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে রায় বুধবার ঘোষণা করবে জেলা জজ আদালত। এ মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এছাড়া মো. মুসা নামে এক আসামি এখনো পলাতক।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, রিফাত শরীফ বরগুনা থানা এলাকায় ডিশলাইনের ব্যবসা করতেন। ১ নম্বর আসামি নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ একসঙ্গে বরগুনা জিলা স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল।

এদিকে ২০১৭ সালে রিফাতের সঙ্গে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির প্রেম হয়। পরে রিফাতের মাধ্যমে তার বন্ধু নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে রিফাত শরীফ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেড় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

পরে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর নয়ন বন্ডের বাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে তাকে গোপনে বিয়ে করেন মিন্নি। বিয়ের বিষয়টি গোপন রেখে রিফাতের সঙ্গে পুরোনো প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যান মিন্নি। এর কিছুদিন পর আগের একটি মামলায় নয়ন বন্ডকে কারাগারে পাঠায় আদালত। তাকে তালাক না দিয়েই ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল রিফাতের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মিন্নি।

অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, নয়ন বন্ড জামিনে মুক্তি পেলে মিন্নি অত্যন্ত চতুরভাবে দুই স্বামীর সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি নয়ন বন্ডের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন এবং তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন।

এক পর্যায়ে রিফাত বিষয়টি জেনে যান এবং এ নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। তখন মিন্নি রিফাতের কাছে ডিভোর্স চান এবং নয়ন বন্ডের কাছে ফিরে যেতে চান।

 অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, রিফাতের সঙ্গে বিয়ের আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নয়ন বন্ড নিজের জন্মদিন পালন করেন। ওই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিন্নি। সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিলেন নয়ন বন্ডের বন্ধু হেলাল শিকদার। এ ভিডিও তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। এটি দেখে রিফাত ২৪ জুন হেলাল শিকদারকে ডেকে নিয়ে ভিডিওটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান।

পরে হেলাল বিষয়টি নয়ন বন্ডকে জানান। নয়ন বন্ড বিষয়টি রিফাত ফরাজীকে জানান। রিফাত ফরাজী মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফের কাছে মোবাইল ফোনটি ফেরত চাইলে রিফাত তাকে গালাগাল করেন। বিষয়টি মিন্নিকে জানান নয়ন বন্ড। এ নিয়ে মিন্নির সঙ্গে রিফাত শরীফের ঝগড়া হয় এবং এক পর্যায়ে রিফাত শরীফ মিন্নির তলপেটে লাথি মারেন। এতে ক্ষুব্ধ মিন্নি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ফোনে ঘটনাটি নয়ন বন্ডকে জানান এবং পরদিন ২৫ জুন কলেজে যাওয়ার নাম করে নয়ন বন্ডের বাড়িতে যান। সেখানে মিন্নি পথের কাঁটা দূর করার জন্য নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

মিন্নির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে নয়ন বন্ড ওই দিন বিকেলে বরগুনা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে আসামিদের সঙ্গে বৈঠক করে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একইসঙ্গে আসামিদের পরদিন সকালে কলেজের সামনে উপস্থিত থাকতে বলেন।

হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২৬ জুন সকালে মিন্নি বরগুনা সরকারি কলেজের সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন ও রিফাত হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করেন।

আসামিদের খালি হাতে দেখে মিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং রিফাত ফরাজীর কাছে জানতে চান, তারা খালি হাতে কেন এবং রিফাত শরীফকে কী দিয়ে মারবে? ওই সময় মিন্নিকে নিতে কলেজের গেটে আসেন রিফাত শরীফ। তখন মিন্নি রিফাত শরীফের সঙ্গে কলেজের গেটের সামনে রাখা মোটরসাইকেলের কাছে যান। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গেটের আশপাশে থাকা আসামিদের সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং সময়ক্ষেপণ করার জন্য মিন্নি পুনরায় কলেজে ফিরে যান। এ সময় মিন্নিকে ফেরাতে রিফাত শরীফ পেছনে পেছনে কলেজের দিকে যান। তখন রিফাত শরীফের ওপর হামলা করার জন্য আসামিদের ইশারা দেন মিন্নি। আসামি রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা মিন্নির স্বামীকে জাপটে ধরে মারতে মারতে টেনে-হিঁচড়ে ক্যালিক্স একাডেমির সামনে নিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় মিন্নি স্বাভাবিকভাবে তাদের পেছনে হেঁটে যান।

অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, আসামি রিফাত ফরাজী দৌড়ে গিয়ে পূর্ব পাশের দেয়ালসংলগ্ন গলির মুখে জনৈক নুরুল হকের বারান্দার টিনের চালের ওপরে রাখা ব্যাগের মধ্য থেকে দুই হাতে দুটি বগি দা নিয়ে আসেন। একই সময় আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার দৌড়ে গিয়ে দুটি লাঠি নিয়ে আসেন। আসামি রিফাত ফরাজী একটি দা রাস্তার ওপরে রেখে অন্যটি দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় রিফাত ফরাজীর হাত থেকে বগি দা নিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন নয়ন বন্ড। আসামি রিফাত ফরাজী তখন রাস্তার ওপরে রাখা অন্য দা নিয়ে পুনরায় রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন।

আসামি রিশান ফরাজী তখন রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখেন। আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার লাঠি হাতে হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করার জন্য পাহারা দেন। ওই সময় আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম, সিফাত, মো. নাজমুল হাসান, প্রিন্স মোল্লা, আবু আবদুল্লাহ রায়হান, আল কাইয়ুম রাব্বি আকন, নাঈম, অলি উল্লাহ অলি, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন, মো. হাসান, মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লাহ, মো. মুসা, মারুফ মল্লিক ও রাতুল সিকদার জয় পাহারা দেন।

আসামি মিন্নি শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও পরে দায় এড়ানোর জন্য কৌশলে রিফাতকে বাঁচানোর অভিনয় করেন এবং শুধু নয়ন বন্ডকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। এরপর লোকজন জড়ো হলে তারা পালিয়ে যান।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিন্নি ঘটনার দায় এড়াতে যেহেতু স্বামীকে বাঁচানোর অভিনয় করেন, এ কারণে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা মিন্নিকে আঘাত করেননি। এ সময় রক্তাক্ত রিফাত শরীফ একাই রিকশায় করে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলেও মিন্নিকে তখন রাস্তায় পড়ে থাকা তার ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা কুড়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পরে মিন্নি রিকশায় করে রিফাত শরীফের সঙ্গে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর মুমূর্ষু রিফাত শরীফকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন চিকিৎসকেরা। তখন মিন্নি তার জামাকাপড় রক্তে ভেজা, তাই বরিশাল যাওয়া সম্ভব নয়—এই অজুহাত দেখিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যান এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে মোবাইল ফোনে দ্রুত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি মিন্নি, রিফাত ফরাজী, রাশিদুল হাসান রিশান, মো. হাসান, টিকটক হৃদয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এ ছাড়া ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা সাক্ষীদের জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, সিসিটিভি ফুটেজ, সিডিআর এবং সার্বিকভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্যে প্রাপ্ত তথ্যে আসামি মিন্নির বিরুদ্ধে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

আমারসংবাদ/জেডআই