Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিহীন

প্রিন্ট সংস্করণ॥মোহাম্মদ আবু নোমান

ডিসেম্বর ১০, ২০১৯, ০৭:৪৮ পিএম


দুই কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিহীন খুবই হতাশা ও উদ্বেগজনক খবর বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের খাদ্যঘাটতি পূরণ শীর্ষক প্রতিবেদনে। তা হলো, দেশের প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের, অর্থাৎ ২ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। প্রায় ৪ কোটি মানুষ যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য পাচ্ছে না। এছাড়া সুষম খাবার কেনার সামর্থ্য নেই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের। এ প্রতিবেদনটি যৌথভাবে তৈরি করে বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। গত ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে পুষ্টিসম্মত খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং মানুষের তা কেনার সামর্থ্য কতটুকু আছে, তা নিয়ে বিশদ তথ্য ও বিশ্লেষণ করা হয়। অবশ্য হতাশার মধ্যে ক্ষেত্রভেদে ‘ইসৎ’ সাফল্যের চিত্রও রয়েছে। তা হলো, বাংলাদেশ অপুষ্টির কারণে শিশুদের যে খর্বাকৃতির সমস্যা ছিল, তা গত ২১ বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৯৯৭ সালে যেখানে দেশে ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির ছিল, ২০১৮ সালে তা কমে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখনো অনেক-অনেক বেশি। একটি দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার দিক থেকে খর্বাকৃতির শিশু একটি বড় সমস্যা ও বাধা। এছাড়া দেশে নারীদের পুষ্টির পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি ৩ জনের ১ জন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না। আমরা জানি, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে সরকার বসে নেই। বর্তমান সরকার পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। অপুষ্টি মোকাবিলায় মাতৃত্বকালীন ভাতা দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার দেয়াসহ নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাদের অনেকেই অজ্ঞতার কারণে পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার খান না। কিনে খাওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, তারা পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য খেতে পারেন না, এটা একটি বিষয়! কিন্তু যাদের সামর্থ্য আছে তাদের অধিকাংশের পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে ধারণা কম। উচ্চবিত্তরা পুষ্টিকর, পছন্দের ও মুখরোচক খাবার বলতে বুঝে থাকেন বার্গার, ফ্রাইড চিকেন, হটডগ, মিষ্টি ছাড়াও নানা ফাস্টফুডের খাবার। খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে পুষ্টি পরিস্থিতির যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তা অনেকেই ভুলে যান। সামর্থ্য থাকলেও মানুষ সঠিক খাদ্য কিনে না খাওয়ার কারণে পরিসংখ্যানে হিতে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। তা হলো, পুষ্টি বাড়ার বদলে দেশে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০০৪ সালে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৯ শতাংশ স্থূলকায় ছিল। এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী তা বেড়ে ২৪ শতাংশে ছাড়িয়েছে। এতে উচ্চবিত্তদের অতি লোভ ও পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে ৪০ শতাংশ খরচ বাড়ার সাথে দেশে বছরে ৮ শতাংশ খাদ্য অপচয় হয় বলে বলা হয়েছে। দেশে একদিকে খাদ্যের অপচয়, অন্যদিকে ক্ষুধায় হাহাকার। দেখা যাচ্ছে খাদ্য সংকটের কারণ, সম্পদের স্বল্পতা নয় বরং অপচয়। ইতোমধ্যে নানা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। জীবনযাত্রার মানের সাথে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মানুষের জীবনমান ও খাদ্যাভ্যাসেই শুধু পরিবর্তন হয়নি, খুবই বাড়াবাড়ি রকম পরিবর্তন হয়েছে খাবার অপচয়েও। আমাদের দেশে নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের উছিলায়, সব ধরনের পার্টি সেন্টার, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ফাস্টফুট ও তারকা হোটেলগুলোতে যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয়, তা দিয়ে বছরে ৬০ হাজার লোককে প্রতিদিন একবেলা করে খাওয়ানো যায়। উচ্চবিত্তরাই মূলত অপচয়টা বেশি করে থাকেন। অন্যদিকে আর্থিকভাবে সামর্থ্য না থাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অতিপ্রয়োজনীয় অনুপুষ্টিকণারও ঘাটতিতে রয়েছে। কেননা, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার জোটাতে পারছে না। খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পুষ্টির ওপর প্রভাব ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ খাদ্যপণ্যের দামের সঙ্গে অসম সমঝোতা করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। দামের অস্থিরতা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুষ্টি গবেষকরা বলছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র পরিবার মাছ, মাংস, ডিম, দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য তো কম খায়ই, সাধারণ খাদ্যও পরিমাণে কম খায়। উচ্চ মূল্যের কারণে অপুষ্টিকর খাদ্য খেতে বাধ্য হয় তারা। ভাত খাওয়ার পরিমাণ না কমলেও ছোট মাছ, বড় মাছ, দুধ, ডিম, মাংস ও ডাল খাওয়া অনেকের কাছেই কল্পনা এখন। ডব্লিউএফপি-এর পরিসংখ্যানে এখনো বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ অতিদরিদ্র এবং তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। সুষম পুষ্টিকর খাবারের তালিকায় যা রয়েছে— ভাত, রুটি, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেলজাতীয় খাদ্য যা অনেক মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কেনার সামর্থ্য নেই। বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক নয়। দেশের এক শ্রেণির মানুষের অতি অপব্যায়, অন্যদিকে এক শ্রেণির মানুষের দারিদ্র্যতা ও পুষ্টিকর খাদ্য নিয়ে জ্ঞানের অভাব এর জন্য মূলত দায়ী। ‘আমার বাচ্চা তো চিকেন ফ্রাই ছাড়া কিছু খেতেই চায় না।’ ‘আমারটা তো ভাতই খায় না, প্রতি বেলায় ওর ফাস্টফুড চাই।’ ‘এগুলো না দিলে তো ও না খেয়েই থাকবে।’ মায়েরা এখন সন্তানদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে এই কথাগুলোই বলে থাকেন। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, অভ্যাস পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা কি সত্যি আপনি করেছেন? সত্যি কি আপনি এ বিষয়ে সচেতন ও জোরদার ভূমিকা রাখছেন পরিবারে? নাকি ফাস্টফুড আপনার জীবনকে অনেক সহজ ও ঝামেলামুক্ত করে দিয়েছে বলে আপনিও ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছেন। ৩০টা দেশের পাঁচ লাখ শিশু ও টিনএজারের ওপর এক জরিপে দেখা যায়, যারা সপ্তাহে তিন দিন কোনো না-কোনো ফাস্টফুড খায়, তাদের অ্যালার্জি ও হাঁপানির ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। কারো শিশু অপরিচ্ছন্ন অবিশুদ্ধ পানি খেতে চাইলে তা কোনো মা-বাবাই দেবেন না। কেননা, তার কারণে সে অসুস্থ হতে পারে। অথচ ফাস্টফুড খেতে চাইলে তা অবলীলায় দেয়া হয়। জিহ্বার স্বাদ যে অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয় সেটা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভাগে উদ্ভাবিত একটি শব্দ বন্ধ যা দিয়ে ওই সকল খাবারকে বোঝানো হয় যেগুলো খুব অল্প সময়ে, তাড়াতাড়ি (ইন্সট্যান্ট) তৈরি ও পরিবেশন করা যায়, তা হলো ‘ফাস্টফুড’। ফাস্টফুডসহ পথের ধারের খাবার গো-গ্রাসে গেলেন অনেকেই। ছুটির দিনে, কাজের ফাঁকে, আড্ডায় শহরবাসীর খাবার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে এ খাবার। এখন রাস্তার পাশেই অহরহ মেলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, চিকেন ফ্রাই, চিকেন বল, স্পাইসি চিকেন, স্ন্যাক, টেস্টি সাব, পিৎজা, স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, কেক, বিস্কুট, শিঙাড়া, সমুচাসহ মুখরোচক সব খাবার। চটজলদি খিদে মেটালেও এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য যে মারাত্মক ক্ষতিকর এ তথ্যও কারো অজানা নয়। সাধারণত এ ধরনের খাবারে থাকে চর্বিযুক্ত মাংস, এছাড়াও থাকে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও লবণ। এই ধরনের খাবার খুবই সুস্বাদু এবং মুখরোচক হওয়ায় ক্রেতাদের সহজেই আকৃষ্ট করে। ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়তে আসক্তির কারণে স্থুলতা বা ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যা তো হয়েই থাকে। এছাড়া দেহের অতিরিক্তি ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগ, কিডনি রোগ, সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে। গবেষণা দেখা গেছে, অতিরিক্ত ওজনধারিদের অকাল মৃত্যুর হার অনেক বেশি। অথচ ফাস্টফুডের লোভনীয় স্বাদের কাছে হেরে যাচ্ছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। আকর্ষণীয় এবং মুখরোচক হবার কারণেই সব বয়সী মানুষ বিশেষ করে শিশুদের কাছে ফাস্টফুডের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। লন্ডনে ইতোপূর্বে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ থেকে ৫ বছরের ৪ হাজার শিশুর ওপর চালোনো গবেষণায় বিজ্ঞানিরা বলেন, ফাস্টফুড খাওয়ায় ফলে শিশুদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে যেসব শিশুদের ফলমূল, শাকসবজিসহ গৃহে তৈরি তাজা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হয়, তাদের আই কিউ ৫ পয়েন্ট পর্যন্ত বেড়ে থাকে। তাই শিশুদের ফাস্টফুডে অভ্যস্ত না করে ফলমূলের প্রতি চাহিদা বাড়ানো উচিত। এছাড়া সকলেই জ্ঞাত, ফাস্টফুড রক্তে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দিয়ে ধমনিতে ব্লক সৃষ্টি করে। পাশাপাশি উচ্চমাত্রার লবণ, টেস্টিং সল্ট বা মনো সোডিয়াম গ্লুটামেট ও কৃত্রিম রং থাকায় ফাস্টফুড উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করে। সকলকেই নিজের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে, জেনে বুঝে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য বলা হয় ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। সবাইকে নিজ পরিবার, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্তোরাঁ, ক্যান্টিন, ফাস্টফুডের দোকান, সুপার মার্কেটসহ যেখানে খাদ্য তৈরি, বিক্রি অথবা খাওয়া হয় সব জায়গাতেই খাদ্যাভাসে শৃঙ্খলাসহ মানবিক ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের অপুষ্টি দূর করতে হলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় করা দরকার। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টি বিষয়ে ডিগ্রি নিচ্ছে অনেক ছেলেমেয়ে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আমরা আশা করি। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট এসটিএমএ