Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশ!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

জুন ৩০, ২০২০, ০৭:৫৮ এএম


বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশ!

 

২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবসে বালুচিস্তানের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার একটি টুইট নিয়ে ঝড় বয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। বালুচিস্তান রিপাবলিকান পার্টির নেতা, ব্রহুমদাগ বুগটি এই টুইটে বাংলাদেশকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছিলেন, “তারা (বাংলাদেশ) স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছিল সাহসী সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে। বালুচ জাতি একই ধরণের বিজয়ের প্রত্যাশা করে এবং আমরা আশা করি শীঘ্রই এই বিজয় আমরা অর্জন করবো।”

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বুগটি জেনেভায় বসে যে দলটির নেতৃত্ব দেন, সেটি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। তারা পাকিস্তান থেকে বালুচিস্তানকে আলাদা করে সেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চান। আর তাদের এই স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলাদেশকে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করেন।

শুধু বুগটির দলের কাছেই নয়, বালুচিস্তানে আরও যে প্রায় আধা ডজন বিচ্ছিন্নতাবাদী দল বা গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে স্বাধীন বালুচিস্তানের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তারা প্রায়শই তাদের আন্দোলনকে তুলনা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে।

সোমবার (২৯ জুন) পাকিস্তানের করাচির স্টক এক্সচেঞ্জে যে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছিল, সেটিও বালুচিস্তানেরই একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এরই মধ্যে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তাদের হামলায় অন্তত দুজন নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আর হামলাকারীদের চারজনকেই পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে।

করাচির এই হামলার পর আবারও বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। সশস্ত্র বালুচ গোষ্ঠীগুলোর এধরণের হামলা এটাই প্রথম নয়।

পাকিস্তানে বালুচদের স্বাধীনতার লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও অনেক আগে শুরু হয়েছিল। এটা সত্যি, যে ধরণের বঞ্চনা-বৈষম্য এবং জাতিগত-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন গতি পেয়েছিল, পাকিস্তানের বালুচদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পেছনেও সেরকম অনেক কারণ নিহিত।

আয়তনের দিক থেকে বালুচিস্তান হচ্ছে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। বালুচিস্তানের আয়তন ৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৯০ কিলোমিটার, যা পাকিস্তানের মোট আয়তনের প্রায় ৪৩ শতাংশ। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে ছোট। রাজধানী হচ্ছে কোয়েটা।

ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের বিবেচনায় পাকিস্তানের জন্য এই প্রদেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বালুচিস্তানের উত্তর-পূর্ব দিকে আছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখোয়া, পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্বদিকে সিন্ধু, দক্ষিণে আরব সাগর, পশ্চিমদিকে ইরান, আর উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিকে আছে আফগানিস্তান।

প্রদেশের প্রধান জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে বালুচ এবং পশতুন। বালুচরা প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ। আর পশতুনরা ৩৬ শতাংশ। এর বাইরে আছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী - ব্রাহুইস, হাজারা, সিন্ধী, পাঞ্জাবি, উজবেক।

বালুচিস্তানের রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশেষ করে গ্যাস এবং কয়লার বিশাল মওজুদ। আছে তামা এবং সোনা। বালুচ জাতীয়তাবাদীরা বহু বছর ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছে যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শোষন করছে এবং বালুচিস্তানকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে।

অর্থনৈতিকভাবে বালুচিস্তান এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। পাকিস্তানের সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বালুচদের বিরুদ্ধে বৈষম্যেরও ব্যাপক অভিযোগ আছে।

পাকিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বালুচিস্তানেই, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৪৮ সালে। বালুচিস্তানে যে চারটি প্রিন্সলি স্টেট ছিল, তার তিনটি ১৯৪৭ সালেই পাকিস্তানে যোগ দেয়- মাকরা, লাস বেলা এবং খারান। কিন্তু চতুর্থ একটি প্রিন্সলি স্টেট, খান অব কালাতের শাসক আহমদ ইয়ার খান প্রথমে পাকিস্তানের যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালে যখন তিনি পাকিস্তানে যোগ দেয়ার জন্য রাজি হন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন তার ভাই প্রিন্স আগা আবদুল করিম বালুচ। তারাই বালুচিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেন।

এরপর এ পর্যন্ত বালুচিস্তানে অন্তত পাঁচবার স্বাধীনতার প্রশ্নে সশস্ত্র সংঘাত হয়েছে। প্রতিবারই নিষ্ঠুরভাবে এসব বিদ্রোহ দমন করা হয়।

বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন এখন নানা ধারায় বিভক্ত। কোন কোন গোষ্ঠী কেবল অধিকতর স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন করছে। কোন কোন গোষ্ঠী বালুচিস্তানকে একেবারে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে।

বালুচিস্তানে এরকম প্রায় আধা ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা আছে, যারা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য লড়ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। এরা আগেও পাকিস্তান সরকারকে টার্গেট করে বিভিন্ন হামলা চালিয়েছে।

২০১৮ সালে বালুচ লিবারেশন আর্মি করাচির চীনা কনস্যুলেট ভবনে হামলার চেষ্টা চালায়। সেই হামলায় নিহত হয়েছিল ৪ জন। তবে কনস্যুলেটের ভেতরের কেউ এই হামলায় হতাহত হয়নি।

গত বছর বালুচিস্তানের বন্দর নগরী গোয়াদারে বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি একটি পাঁচ তারকা হোটেলে হামলা চালায়। গোয়াদারে চীন কয়েকশো কোটি ডলারের যে বিশাল প্রকল্পের কাজ করছে, এই পাঁচতারা হোটেলটি তারই অংশ। বিএলএ সেখানে হামলা করেছিল চীনা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আঘাত হানার জন্য।

বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেখানে চীনা বিনিয়োগের বিপক্ষে। তারা মনে করে, এতে বালুচিস্তানের স্থানীয় মানুষের কোন উপকার হবে না।

প্রথম দিকে বিএলএ বালুচিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা সহিংস বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ বেছে নেয়। পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র এটিকে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট হচ্ছে আরেকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। ১৯৬৪ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি বেশ জনপ্রিয় বালুচদের মাঝে।

বালুচ রিপাবলিকান পার্টি, যেটির নেতৃত্বে আছেন ব্র্রহামদাগ বুগটি, সেটি প্রতিষ্ঠা করেন তার পিতামত নবাব আকবর খান বুগটি। এটিও বৃহত্তর বালুচিস্তানের স্বাধীনতার কথা বলে। তাদের সঙ্গে বালুচ লিবারেশন আর্মির সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেন কেউ কেউ।

বালুচিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আছে। সেখানে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা ঠিকমত তাদের কাজ করতে পারেন না।

বিএলএ এবং এরকম অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বালুচিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় তাদের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান থেকেও তারা তৎপরতা চালায় বলে মনে করা হয়।

নিরাপত্তা বাহিনী নিয়মিতই এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বালুচিস্তানে শত শত রাজনৈতিক কর্মী এবং সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং পরে তাদের লাশ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করেছে। তাদের অভিযোগ এর পেছনে আছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী।

মানবাধিকার কর্মীরা এগুলোকে বিচার বহির্ভূত হত্যা বলে বর্ণনা করেন।

তবে পাকিস্তান সরকার দাবি করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিজেদের অর্ন্তদ্বন্দ্বের ফল এসব হত্যাকান্ড।

২০০৭ সালে সর্বশেষ দফা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ বা নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ করছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।

বালুচিস্তানের এই সশস্ত্র আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে কতটা তুলনা করা যাবে, সেটা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তোলেন অনেকে।

ভারতের ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড এনালাইসিসের একজন গবেষক সুশান্ত সারিন এ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যার শিরোনাম “বালুচিস্তান ইজ নো বাংলাদেশ।”

তিনি লিখেছেন, “এভাবে বালুচিস্তানের পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করে হয়তো বিষয়টিকে ‘সেনসেশনালাইজ‌’ করে দৃষ্টি আকর্ষন করা যাচ্ছে। কিন্তু এটি আসলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আর আজকের বালুচিস্তানে যা ঘটছে তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যকে আড়াল করে ফেলছে।”

সারিন তার লেখায় স্বীকার করছেন যে বালুচিস্তানের মানুষও সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মতো চরম শোষণ-বৈষম্যের শিকার। সেখানে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবির প্রতি বিরাট সমর্থন আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব।

সারিন লিখেছেন, বাংলাদেশের বেলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে মানুষের এই সমর্থনকে সংগঠিত করে এটিকে গণ আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করতে পেরেছে, বালুচিস্তানের বেলায় সেটা অনুপস্থিত। তিনি এর কারণ বিশ্লেষণ করে মূলত বালুচিস্তানের সামন্ততান্ত্রিক ট্রাইবাল সমাজ ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন।

বালুচিস্তানের স্বাধীনতার আকাঙ্খার পথে এখন আরেকটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানকার একটি বিশাল অবকাঠামো প্রকল্পে চীন যুক্ত হওয়ার কারণে। চীনের ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বালুচিস্তানের গোয়াদার বন্দর প্রকল্প।

চীনের অর্থায়নে ‘চায়না পাকিস্তান ইকনোমিক করিডোর বা সিপেক নামের এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য গোয়াদার বন্দরকে পশ্চিম চীনের সঙ্গে যুক্ত করা। এর ফলে বন্দরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হবে।

পাকিস্তানের রাজনীতিক এবং সেনা কর্মকর্তারা এই প্রকল্পটিকে একটি ‘গেম চেঞ্জার’ বলে বর্ণনা করে থাকেন। তাদের দাবি, এর ফলে বালুচিস্তানের অর্থনীতিই পাল্টে যাবে।

কিন্তু বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো মনে করে, এ থেকে স্থানীয়রা কোনভাবেই লাভবান হবে না। তারা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে নিয়মিতই এই প্রকল্পের কাজে বাধা দিতে হামলা চালায়।

এই প্রকল্পটি একটি শ্বেত হস্তীতে পরিণত হতে পারে, এমন আশংকা অনেকের মধ্যে আছে। কিন্তু চীন এই প্রকল্প অব্যাহত রাখতে চায় এবং পাকিস্তান সরকারও যে কোন মূল্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করে প্রকল্পটি শেষ করতে চায়।

আমারসংবাদ/জেআই