Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

ঝুঁকিতে ৮৮ হাজার কারাবন্দি

শরিফ রুবেল

এপ্রিল ৬, ২০২০, ০৭:২২ পিএম


ঝুঁকিতে ৮৮ হাজার কারাবন্দি

  • #শর্ত সাপেক্ষে মিলতে পারে ১-৩ বছরের জামিন
  • #মুক্তি দিয়ে করোনার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব
  • # ৮৬ হাজার ৯৯৮ জন বন্দির চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক আছে ৯ জন
  • #আইনের মধ্যে থেকে লঘু দন্ডপ্রাপ্তদদের মুক্তি দিয়ে ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব মত বিশেষজ্ঞদের
  • # আইনটি কার্যকর করতে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই
  • #সাড়ে তিন হাজার বন্দিকে মুক্তির প্রস্তাব কারাকর্তৃপক্ষের

আরমান হোসেন। আশুলিয়ার জিরাবো এলাকার বাসিন্দা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে নাশকতা ও পুলিশকে লক্ষ করে ককটেল ছোড়ার অভিযোগে মামলা হয় তার নামে। পরে একই মাসে গ্রেপ্তার হয়ে এখনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন আরমান।

নিম্ন আদালতে একাধিকবার চেষ্টা করেও জামিন পাননি। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। অভিযুক্তের পরিবারের দাবি— জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণেই মামলার শিকার হন আরমান।

শুধু আরমানই নন, সারা দেশের ৬৮টি কারাগারে ছোট বড় অপরাধ নিয়ে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি বন্দি কারাভোগ করছেন। তাদের প্রায় ৮০ ভাগই বিচারাধীন মামলার আসামি। সামান্য লঘু অপরাধের অভিযোগেও অনেকে বছরের পর বছর কারাবন্দি আছেন।

এর মধ্যেই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস হানা দিয়েছে সারা দেশে। শুধু দেশ নয়, পুরো বিশ্বই এখন করোনার থাবায় বিপর্যস্ত। করোনা আতঙ্ক বিরাজ করছে ঘরে বাইরে সবখানে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে কারাগারগুলোতেও।

তবে করোনা ভাইরাসের প্রেক্ষাপটে কারাগারগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার আশঙ্কার মধ্যে এ প্রসঙ্গ নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস কারাগারে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন অবস্থায় ১৯৬০ সালের প্রবেশন আইনে অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে মুক্তি দিতে মত দেন তারা। আইনে কারাবদ্ধ না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ প্রদান করার বিধান রয়েছে। শর্তসাপেক্ষে লঘু অপরাধের সংশোধন সুযোগ দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে আইনটিতে।

এদিকে এমনিতেই দেশের কারাগারগুলো ভয়াবহ চিকিৎসক সংকটে ভুগছে, তার ওপর কারাগারে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় সৃষ্টি হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেশের সকল কারাগারে ৮৬ হাজার ৯৯৮ জন বন্দির চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ১৪১টি পদের বিপরীতে চিকিৎসক মাত্র ৯ জন। অধিকাংশ কারাগারেই চিকিৎসক নেই। ফলে সেখানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে শত শত বন্দির জীবন সংকুলানের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে বিচারাধীন মামলার আসামি ও লঘু অপরাধে কম দণ্ডপ্রাপ্ত এবং যাদের তিন ভাগের দুই ভাগ দণ্ড খাটা শেষ হয়েছে— এ ধরনের আসামি বাছাই করে মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারে। আইনে তেমন সুযোগও রয়েছে।

এর আগে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসনিক আদেশে কারামুক্তি দেয়ার নজির রয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ইরান ও ইতালিতেও কারাবন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছে দেশগুলোর সরকার।

তারা বলছেন, এ অবস্থায় আইনের মধ্যে থেকেই কিছু নির্দিষ্ট বন্দি মুক্তি দিয়ে ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব।

কারা কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৪৪ জন কিন্তু গত ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে আটক ছিলেন ৮৭ হাজার ২৬৬ জন।

এর মধ্যে হাজতি ৬৭ হাজার ৭২১ জন, কয়েদি ১৭ হাজার ৫৫৪ জন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক হাজার ৮৬৮ জন, ৫৪ ধারায় আটক আটজন, বিশেষ বন্দি ৩৩ জন, আরপি বন্দি ৮২ জন।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ২০ জন চিকিৎসককে বিভিন্ন কারাগারে নিয়োগ দেয়া হলেও স্বাস্থ্য বিভাগ এখনো ১৬ জনের পদায়ন নিশ্চিত করেনি। পদায়নের অনুরোধ জানিয়ে ৫৫ বার চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে এই ১৬ জনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ব্যবস্থা নিতেও চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

সংশ্লিস্ট সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কারা কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বন্দির সংখ্যা কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এরই মধ্যে তিন হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্তির প্রস্তাব করে একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। জামিনযোগ্য ধারায় তাদের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এরপর বিচারক জামিন দিলেই তাদের মুক্তি দেবে কারা কর্তৃপক্ষ।

করোনা পরিস্থিতিতে কারাবন্দিদের মুক্তির বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কারাগারগুলো খারাপ অবস্থায় রয়েছে।

সেখানে করোনা ভাইরাস ঢুকলে বন্দিদের জীবন রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। আমি মনে করি, যারা বয়স্ক, যাদের সাজার দুই-তৃতীয়াংশ ভোগ হয়ে গেছে, লঘু অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত, অল্প সাজাপ্রাপ্ত- এমন বন্দিদের শর্তসাপেক্ষে সরকার মুক্তি দিতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা কম সাজা পাওয়ার যোগ্য তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে শর্তসাপেক্ষে বাসায় থাকার বিধান দেশের আইনে রয়েছে। একজন প্রবেশন অফিসারের অধীনে লঘু দণ্ডপ্রাপ্তদের ছেড়ে দেয়ার বিধান রয়েছে। উন্নত দেশে এ ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ আইন মানা হয় না।

আইন অনুযায়ী প্রবেশনে পাঠানোর যে ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে কমিটি করতে হবে, প্রবেশন অফিসার নিয়োগ করতে হবে। এসব করা সময়সাপেক্ষ। আমি মনে করি, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বন্দিদের বাঁচাতে সরকারের দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ তার মতামত তুলে ধরে বলেন, সরকার চাইলে আইনের মধ্যে থেকেই কিছু বন্দিকে মুক্তি দিতে পারেন।

যেহেতু দেশ এখন করোনা সংকটে রয়েছে তাই এই জনবহুল কারাগার থেকে বন্দি না কমালে এটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে যেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

তাই কারাগারে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর লঘু অপরাধের বন্দিদের মুক্তি দিলে এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০ : এ আইনের বিধান পালন করলে আগেই কারাগারে বন্দির সংখ্যা অনেক কমে যেতো বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

তিনি বলেন, কারাগারে দেয়া মূলত মানুষকে শুদ্ধ ও সংশোধন হওয়ার জন্য। কিন্তু এখানে যদি তার মৃত্যু ঝুঁকি থাকে তাহলে সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তাই আইনের মধ্যে থেকেই সরকার লঘু অপরাধীদের সংশোধনের জন্য সুযোগ দিতে পারেন এবং তাদের মুক্তি দিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখতে পারেন।

এতে কারাগার কিছুটা ফাঁকা হবে ও বন্দিদের করোনা ঝুঁকিও কমে আসবে। আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীকে সব ক্ষেত্রেই সাজা আরোপ আইন সমর্থন করে না; কেননা সাজা প্রদানের উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়।

আর প্রবেশন আইনটি ৬০ বছর আগে হলেও আজ পর্যন্ত সম্ভবত ৬০ বারও প্রয়োগ হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে এবং আদালত বন্ধ থাকায় এ মুহূর্তে তিনটি পদক্ষেপ জরুরি।

প্রথমত, যেসব অপরাধীর দুবছর বা তার কম সাজা হয়েছে এবং অন্তত ছয় মাস জেল খেটেছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, যেসব বিচারাধীন মামলার আসামি জামিন না পেয়ে দুবছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন না হয়, তা হলে তাদের মুক্তি দিতে হবে।

তৃতীয়ত, নারী কারাবন্দি, তারা দোষী বা বিচারাধীন মামলার যে অবস্থায়ই হোক না কেন, মানবিক দিক থেকে তাদের মুক্তি দেয়া যেতে পারে।

বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে বিদ্যমান আইন যা বলে : ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় দণ্ডিত অপরাধীদের কারাগারের বাইরে রেখে সংশোধনসংক্রান্ত আইন ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০’ রয়েছে। এ আইনে লঘু দণ্ডপ্রাপ্তদের শর্তসাপেক্ষে কারাগারের বাইরে রেখে সংশোধনের সুযোগ দেয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু আইনটির কার্যকারিতা নেই। এ অবস্থায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে কারাগারের ওপর চাপ কমানো এবং ‘সংশোধনমূলক’ সাজার নীতি কার্যকর করতে ১৯৬০ সালের ওই অব্যবহূত আইন কার্যকর করতে বিচারকদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়।

এতে আরও বলা হয়, আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধীকে সব ক্ষেত্রেই সাজা আরোপ আইন সমর্থন করে না; কেননা সাজা প্রদানের উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়।

১৯৬০ সালের ওই অর্ডিন্যান্সের ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী, আগে দণ্ডিত হয়নি- এমন কোনো অপরাধী অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে আদালত অপরাধীর বয়স, স্বভাব-চরিত্র, প্রাক-পরিচয় বা শারীরিক বা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন বা অপরাধ সংঘটনে শাস্তি লাঘবকারী পরিস্থিতি বিবেচনা করে যদি মনে করেন যে দণ্ড প্রদান অসমীচীন এবং প্রবেশনের আদেশ প্রদান করা যথাযথ নয়, তাহলে আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে সতর্ক করে অপরাধীকে অব্যাহতি দিতে পারেন।

অথবা উপযুক্ত মনে করলে অনধিক এক বছর সময়ের জন্য কোনো অপরাধ না করার এবং সদাচারণে থাকার শর্তে জামিনদারসহ বা জামিনদার ছাড়া মুচলেকা প্রদানে বিমুক্ত হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।

ওই আইনের ৫ ধারার বিধান অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডনীয় কোনো অপরাধসহ দণ্ডবিধির অন্য কিছু ব্যতিক্রমধর্মী অপরাধ ছাড়া অন্য সব অপরাধে দণ্ডিত নারী অপরাধীর ক্ষেত্রে আদালত তাৎক্ষণিকভাবে সাজা আরোপ না করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত একজন প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে থাকার নির্দেশ দিতে পারেন।

অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ (১৯৬৪ সনে সংশোধিত) এর আওতায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালত প্রথম ও লঘু অপরাধে জড়িত শিশু কিশোর বা প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে শর্তসাপেক্ষে ১ (এক) থেকে ৩ (তিন) বছরের জন্য প্রবেশন মঞ্জুর করতে পারে। তবে শিশু-কিশোরদের জন্য এ আইনগত সুবিধা অগ্রাধিকার পায়।

এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের নির্দেশনার আলোকে তিন হাজার বন্দির একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি এখন স্বরাষ্ট্র থেকে আইন ও বিচার বিভাগে যাবে।

জামিনযোগ্য ধারায় বিচারক তাদের জামিন দিলেই কারা কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ কারাবন্দিদের মুক্তি দিয়েছে।

আমারসংবাদ/এসটিএমএ